Tuesday 5 July 2011

প্রস্তাবিত পানি আইন: নিছক ব্যবসায়ের জন্য নয়, প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় হোক

পানি; প্রাণ ও প্রকৃতির


শুধু মানুষই নয়, পানি সকল প্রাণ ও প্রকৃতির অধিকার। পানি ছাড়া কোন প্রাণীই বাঁচতে পারে না। পানি প্রকৃতির দান,এটা কেউ তৈরি করেনি। তাই পানিকে কোনভাবেই বানিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। পানি বিষয়ক আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকেই নয়, প্রাণ ও প্রকৃতির স্বার্থ-অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েই হতে হবে।


শুধুমাত্র পানির উৎস ব্যবস্থাপনা কিংবা সরবারহের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রণীত নীতি ও আইনের মাধ্যমে পানির সংকট মোকাবেলা সম্ভব নয়। পরিবেশের অন্যতম এই উপাদানটি রক্ষায় পুরো পানি চক্রটিকে প্রাধান্য দিয়েই পানি নীতি ও আইন তৈরি করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রয়োজন, ভৌগলিক অবস্থান,সামাজিক অবস্থা, রীতিনীতি ঐতিহ্য ও জনগণের আশা-আকাঙ্খা এবং স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে আইন তৈরি করেছে । ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ সদ্ব্যবহার এবং সংরক্ষণ দরকার ।

প্রস্তাবিত খসড়া পানি আইন: সরকারের ক্ষমতা ও জনগনের স্বার্থ

ঋণপ্রদানকারী সংস্থা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-র অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছে খসড়া পানি আইন। আইনটি সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে।। প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়ায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের প্রস্তাব এনে বিকেন্দ্রিকরণ নীতির আড়ালে পানি ও পানির উৎসসমূহকে বেসরকারি খাতে সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে।

প্রস্তাবিত পানি আইনে লাইসেন্সের বিধানের মাধ্যমে জনগণের অধিকারকে বাণিজ্যিক মোড়কে রূপান্তর করে আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। লাইসেন্সের এ বিধান পানি শুধু ব্যবস্থাপনা নয়,নিয়ন্ত্রণকে আইনসিদ্ধ করার প্রচেষ্টা। এর ফলে আইনে প্রাণ ও প্রকৃতির অধিকার উপেক্ষিত হয়েছে। পানি জনগণেরই সম্পদ। এ আইনের মূলনীতিতে সেই পানিতে জনগণের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে, যা সংবিধান ও মানবাধিকার পরিপন্থী।

পানিকে বাণিজ্যিক পণ্য এবং রাজস্ব আয়ের উপকরণ হিসেবে না দেখে জননিরাপত্তা ও জনস্বার্থে ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সম্পদ হিসেবে আইনে পানিকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। লিজিংয়ের মাধ্যমে পানিকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে না নিয়ে আইন ও নীতির মাধ্যমে পানির উপর মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার। ব্যবসায়িক খাতের নিয়ন্ত্রণাধীন পন্যগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার হিমসিম খেতে হচ্ছে। সেখানে পানির মতো একটি মৌলিক প্রয়োজনীয় পন্যের বানিজ্যিকিকরণ সরকারের ক্ষমতাকে সংকুচিত করবে এবং জনগনের অধিকারকে ক্ষুন্ন করবে।

প্রস্তাবিত খসড়ায় পানি অধিকার যেভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে:
১. পানিকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। প্রতিটি নাগরিকের নিকট প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি পৌছে দেয়ার বাধ্যবাধ্কতা প্রদান করা হয়নি।
২. পানির উপর প্রকৃতির অধিকার অর্থাৎ অন্যান্য প্রানীর অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।
৩. পানির উপর বেসরকারি কোম্পানির ক্ষমতা ও অধিকারকে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৪. পানিকে সরকারের সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে,জনগনের নয়।
৫. হাওর ও সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকায় পানি ও জীববৈচিত্র্যকে আইনে সংরক্ষিত করা হয়নি।
৬. প্রাকৃতিক পানির আধারগুলোর উপর বেসরকারি কোম্পানির অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ উম্মুক্ত করা হয়েছে।
৭. আইনটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নগরের কথা বিবেচনা করে প্রণীত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন আচারের কথা বিবেচনা করা হয়নি।
৮. খাল-বিল,নদী-নালা এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর বা জলাশয় থেকেও সাধারণ গৃহস্থালীর কাজের অতিরিক্ত (ঘর ধোয়া) পানি ব্যবহার করলে লাইসেন্স নেয়ার কথা বলা হয়েছে। যা জনগনের অধিকারকে ক্ষুন্ন করবে।

পানির উপর বেসরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
এ আইনের ফলে পানি সরবারহ,পানি উৎস ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ সকল ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে পানির সংরক্ষণের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যার ফলে পানির দাম বৃদ্ধি,কৃত্রিম সংকটসহ নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির হাতে চলে যাবে এবং পানি বাণিজ্যিক রূপ ধারন করবে। নাগরিকের নূন্যতম পানি সরবারহের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা না থাকা কিংবা বিনামূল্যে বস্তিবাসী, সুবিধা বঞ্চিত মানুষ পানি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। পানি সরবারহে কোম্পানির সুযোগ বৃদ্ধি করার ফলে রাষ্ট্রীয় সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আওতা সীমিত হয়ে পড়েবে। পানির উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। কোনো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করতে চাইলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে নির্দিষ্টি অংকের ফি জমা দিয়ে পানি সম্পদ কাউন্সিলের নির্বাহি কমিটিতে আপিল করতে হবে।

সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য গণ্য করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকারের (Right to life) কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশুদ্ধ পানি ছাড়া জীবনধারণ অসম্ভব। তাই জীবনের অধিকার বলবৎ করতে চাইলে অবশ্য বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিশুদ্ধ ও জীবাণুমুক্ত পানি পাওয়ার অধিকারকে তাই পরোক্ষভাবে বলা যায়, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। সে অধিকার বাস্তবায়নে সরকার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দেখাবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিবে এটাই এখন জনগণের প্রত্যাশা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পানি-পরিস্থিতি
কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে খাবার পানি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। একেক জনকে দিনে ৫ ঘণ্টা এই কাজে ব্যয় করতে হয়। ইনডিয়া, পাকিস্তানে বহু অঞ্চল আছে যেখানে একটি জলাশয় বা কূপ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসে,এর কোন বিকল্প নেই। সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ দূর করে সুপেয় পানির যোগান দিচ্ছে। একই দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন প্রদেশ বা রাজ্যের মধ্যে পানি নিয়ে বিরোধের নজির রয়েছে। ইনডিয়ার কর্নাটক এবং তামিলনাড়– রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিরোধে বড় ধরনের দাঙ্গা পর্যন্ত সংগঠিত হয়েছিল।

পানি বেসরকারিকরণের অভিজ্ঞতা
পানি বেসরকারিকরনের ফলে বিশ্বে পানি ব্যবসার পেছনে ১০টি কোম্পানীর বিনিয়োগ ৪০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ১০টি কোম্পানির সবই ব্রিটেন,ফ্রান্স,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জর্মানির। ইনডিয়া,বলিভিয়া,চিলি,আর্জেন্টিনা, মালয়েশিয়া,অস্ট্রেলিয়া,যুক্তরাজ্য,দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন শহরে পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকানি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রকেটে গতিতে পানির দাম বৃদ্ধির ফলে অনেক দেশে মানুষ রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে।

১৯৯০ সালের শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে পানিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পালা শুরু হয়। আর এর পিছনের শক্তি হিসেবে কাজ করে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ। বিভিন্ন দেশে লোন সহায়তা,উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রীয় পানি সেবা ব্যবস্থাপনাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। ২০০০ সালে আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের অঙ্গসংস্থা আইএফসি’র মাধ্যমে ৪০টি লোন রিলিজ করে। এর মধ্যে ১২টি লোন প্রকল্পের শর্ত ছিল আংশিক বা পুরোপুরিভাবে পানিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া। বিশ্বব্যাংকের চাপে পানিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া এবং পানি নিয়ে গণ-আন্দোলনের উদাহরন বলিভিয়া। বলিভিয়ার কোচবাম্বা এলাকাটি মরূপ্রধান । পানি সেখানে খুব দুস্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। কোচবাম্বা পৌর এলাকার পানি সরবাহকারী সংস্থা সেনিয়াপাকে বেসরকারি করার জন্য চাপ দেয় বিশ্বব্যাংক। ব্যাংক কর্মকর্তারা সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেন,যদি কোচাম্বার পানি সরবারহ সংস্থাকে বেসরকারিকরন না করা হয় তাহরে ৬০ কোটি ডলারের ঋণ তুলে নেয়া হবে।

বিশ্বব্যাংকের চাপে বলিভিয়া ১৯৯৯ সালে পানি আইন পাস করে। পানি আইনে পানি খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং পৌর এলাকার পানিতে সরকারি ভর্তুকি প্রদানও বন্ধ করা হয়। কোচাম্বার পানি সরবারহের দাযিত্ব পায় য়ুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর কোম্পানি বেচটেল। বেসরকারি মার্কিন সংস্থার কাছে পানি সরবারহের দেয়ার সাথে সাথে মাসে পানির বিল ২০ ডলারে পৌছে যায়- যেখানে সাধারন মানুষের মাসিক নুন্যতম বেতন ছিল মাত্র ১০০ ডলার। পানির এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে নগরবাসি রাজপথে নামে ২০০০ সালে। কোচাম্বার দোকান-পাট চারদিন বন্ধ রাখা হয়। এরপর ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয় এবং সব যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া হয়। পিপসার্ত উত্তাল জনতার রোষ মোকাবেলায় সরকার সামরিক আইন জারি করে এপ্রিল মাসে। গুলিতে ৬জন নিহত হয়। শত শত আন্দোলন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। অবশেষে বেচটেল বলিভিয়া থেকে পলায়ন করে।

বিশ্বের ১৪০টি দেশে বেচটেলের ১৯ হাজার প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ২০০টিই পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত। ভারতের বিশ্বনাথ নদী ছত্রিশগড় শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন এবং পানি পরিশোধন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে রেল কলোনির লোকদের দিনে মাত্র ৪ লিটার পানি দেয়া হতো এবং প্রতি লিটারের জন্য ১২ রুপি ৬০ পয়সা দিতে হতো। জনসাধারনকে নদীতে গোসল এবং মাছ ধরার অনুমতিও দেয়া হতো না।

পানিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর যুক্তরাজ্যে পানির দাম ৪৫০গুন বেড়ে যায়,বেসরকারি পানি সরবারহ কোম্পানির লাভ বাড়ে ৬৯২গুন। আর ওই কোম্পানি নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন বাড়ে ৭০৮গুন। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসেসিয়েশন বেসরকারি খাতে পানি সরবারহের দায়িত্ব প্রদানকে নিন্দা জানিয়ে বলেছে,এর ফলে মানুষের আমাশয় আক্রান্ত হওয়ার হার ছয়গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্রান্সে পানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর পানির ফি ১৫০ শতাংশ বেড়ে যায়,অন্যদিকে কমতে থাকে পানির মান। সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,৫২ লাখ মানুষ দূষিত পানি পেয়েছে কোম্পানি থেকে।

অস্ট্রেলিয়ায় সুয়েজ লিওনাইজ নামে ফ্রান্সের একটি কোম্পানির হাতে পানির দায়িত্ব দেয়ার পর দূষিত পানি সরবারহ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আর্জেন্টিনায়ও সুয়েজ লিওনাইজের হাতে পানির দায়িত্ব দেয়ার পর পানির দাম দ্বিগুন বৃদ্ধি পায়। নিউজিল্যান্ডে পানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর জনতা রাজপথে বিক্ষোভ করতে বাধ্য হয়।

প্রস্তাবিত পানি আইন: নিছক ব্যবসায়ের জন্য নয়, প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় হোক
রাজনৈতিক ডম কম থেকে www.rajnoitik.com

পানি খাতে ব্যবস্থাপনা নাকি পানি বানিজ্যিকীকরন

অব্যাহতভাবে পানির আধারগুলো ধ্বংস ও যথেচ্ছ পানির ব্যবহার তথা অপচয়ের কারনে পানি ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য সম্পদের পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় সাতশ নদ-নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল, দীঘি-পুকুর ও হাওড়-বাওড়, ঝর্না রয়েছে। সারা দেশব্যাপী নদ-নদী বিস্তৃন থাকায় এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকাসহ জীববৈচিত্র্য বহুলাংশে পানির উপর নির্ভরশীল। তাই শুধুমাত্র ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই নয় এই অঞ্চলের পানি আইন ও নীতিমালায় প্রতিটি সংশ্লিষ্ট সকল স্বার্থ ও অধিকারকে প্রাধান্য দিয়েই হতে হবে। পানিখাতে সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার স¤প্রতি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা প্রশংসার দাবী রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার একটি খসড়া পানি আইন তৈরি করেছে যা শীঘ্রই সংসদে পাশ হবে। এই আইনটি দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থপনার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হলেও কিছু কিছু অংশ সংশোধন না করা হলে আইনটি পানির উৎস ধ্বংস, পানি সম্পদের প্রতি জনগণের অধিকার সংকোচণের পাশাপাশি বাণিজ্যিকীকরণ অন্যতম সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে।



বিশ্বের প্রায় ৩১টি দেশে পানির অভাব রয়েছে এবং ১ বিলিয়ন লোক পরিস্কার সুপেয় পানির অভাবে রয়েছে। প্রতি ২০ বছরে পানির ব্যবহার দ্বিগুণ হচ্ছে এবং পানির উৎসগুলো দ্রুত দূষিত হচ্ছে, শিল্প, কৃষি এবং বিদ্যুৎ তৈরীর জন্য ব্যবহার হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পরিস্কার ও সুপেয় পানির অভাব অনুভব করবে। শুধু মানুষ নয় জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ-প্রতিবেশ বহুলাংশ নির্ভর করে পানিচক্রের উপর। বন্দনা শিবা তার ‘Water Wars’ বইতে বলেন, পানি সকলের জন্য, পানি ব্যাক্তিগত সম্পত্তি নয় কিংবা বিক্রয়ের পন্য নয়। পানি প্রকৃতির উপহার বা সম্পদ হওয়ার পরও কোম্পনীগুলো পানিকে উচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেষ্ঠা চালাচ্ছে যা কিনা গরিবদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।



GATS (General Agreement on Trade in Services) চুক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল পানিকে ব্যাক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। কোন রকম লাভের লক্ষ্য না নিয়ে বিশ্বব্যাপী সরকার ট্রিলিয়ন টাকা খরচ করে পাইপিং সিস্টেম চালু করেছে। WTO, World Bank, Azurix (Subsidiary of Enron), Vivendi (Formerly Lyonnaise des Eaux) এবং International Water limited এর মতানুযয়ী এটা অপচয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় পানির মূল্য খুব স্বল্প ছিল। সরকার শুধুমাত্র পাইপ কাভারিং-এর মূল্য নিত। কিন্তু এ সকল গোষ্ঠীর মতে বোতলজাত প্রক্রিয়ায় উচ্চমূল্যে পানির বাজার তৈরী করা সম্ভব। পানির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও এ সকল গোষ্ঠীগুলোর বানিজ্যিক চিন্তা ছিল। আর বিশ্বব্যাপী তারই ধারাবাহিক রূপরেখা বাস্তবায়ন চলছে। পানির আর্থিক মূল্য অবশ্য বিবেচনা করতে হবে তবে অধিকার ও সেবার পরির্বতে শুধুমাত্র আর্থিক দিকে বিশেষ প্রাধান্য দিলে এই সেক্টর অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগীতা সৃষ্টি করবে।



অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত উভয় দিক হতেই এই সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা অতি জরুরি। কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য সুষম নীতি কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানগত সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ নির্দিষ্ট করতে হবে। কেননা এই দুটি বিষয়ে দক্ষতার সাথে সরকারকে প্রয়োজনীয় ও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। বর্তমান পানি নীতি পুরোটাই সীমাবদ্ধ পানি সরবরাহকে প্রাধান্য দিয়ে এবং আইনে তা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পানি নীতিকে বহুমুখী করতে হবে। পানি প্রাকৃতিক সম্পদ আর এর ব্যবহারের অধিকার দেশের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও জনগনের। শুধুমাত্র পানি উৎস ব্যবস্থাপনা কিংবা সরবারহের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রণীত নীতি ও আইন মাধ্যমে আসন্ন পানির সংকট মোকাবেলা সম্ভব নয়। পরিবেশের অন্যতম এই উপাদানটির রক্ষায় পুরো পানি চক্রটিকে প্রাধান্য দিয়েই পানি নীতি ও আইন তৈরি করতে হবে। একটি বিশেষ দিকের প্রতি বিবেচনা না করে পরিবেশ, প্রতিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, অধিকার, রাজনৈতিক ও আন্তজার্তিক সকল ক্ষেত্রের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিস্তৃত করতে হবে পানি নীতি ও আইনের পরিধি।



পানি জনগণ ও সরকার উভয়ের সম্পদ তাই এ সম্পদের চাহিদা ব্যবস্থাপনা কেবল মার্কেট ক্লিয়ারিং প্রাইসে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থাপনায় সমাজের নিম্ন আয় ও হত-দরিদ্র শ্রেণীটি পানির মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। তারা এই মৌলিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে। আবার পানি যেহেতু মূল্যবান সম্পদ সেহেতু ভোগের সময় এ সম্পদের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পানি সরবরাহ, সংরক্ষণ এবং গুণাগুণ রক্ষণাবেক্ষণে কোন বিশেষ কোম্পানীর পরিবর্তে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পানি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম অবশ্যিক উপাদান হওয়ার পরও খসড়া আইনটিতে ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে পানি সরবারহে বাধ্যবাধ্যকতা আরোপ করা হয়নি । খসড়া আইনে সাধারন কাজের সংজ্ঞায় রান্না, খাওয়া, থালা-বাসন, কাপড় ধোয়া, গোসলসহ দৈনন্দিন কর্মকান্ড নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু শহর এলাকার বাইরে সাধারণ কাজের পরিধি বিস্তৃণ হওয়া প্রয়োজন। খসড়া আইনে পানিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষার অন্যতম উপদান স্বীকার ও গুরুত্ব প্রদান করা হলেও দেশের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার সুন্দরবন ও হাওড় অঞ্চলের পানি নির্ভর জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি নিয়ে এতে সুস্পষ্ট ধারনা নেই।



পানি সরবারহ, পানির উৎস ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ সকল ক্ষেত্রে বেসরকারী বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কোম্পানীকে লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যার ফলে পানির দাম বৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকটসহ নিয়ন্ত্রণ কোম্পানীর হাতে চলে যাবে এবং পানি বাণিজ্যিক পণ্যের রূপ ধারন করবে। নাগরিকের ন্যূনতম পানি সরবারহের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা না থাকায় বিনামূল্যে বস্তিবাসী, সুবিধা বঞ্চিত মানুষ পানি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। পানি সরবারহে কোম্পানীর সুযোগ বৃদ্ধি করার ফলে রাষ্ট্রীয় সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতা সীমিত হয়ে পড়বে। পানির উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করতে চাইলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে নির্দিষ্ট অংকের ফি জমা দিয়ে পানি সম্পদ কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটিতে আপিল করতে হবে। এর ফলে আপিল করার সুযোগ হারাবে।


দেশের অভ্যন্তরে সকল নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাওড়, জলাধার, অবিরাম জলধারা, ভূ-গর্ভস্থ পানি এবং দেশের সমুদ্রসীমায় পানির মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। সাধারন কাজের বাইরে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। পানির প্রবাহে কোনো ধরনের বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নলকূপ ব্যবহার করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা যাবে না। এছাড়া নিজের জমির পানি অন্য কোন সেচের জমিতে সরবরাহের ক্ষেত্রেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দেশের কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের রাষ্ট্রীয় ভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। হুট করে ভূগর্ভস্থ পানিতে নিয়ন্ত্রণ করা হলে খাদ্য উৎপাদন খরচ ও সংকটসহ বিশৃংঙ্খলা দেখে দিবে। কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানির নিয়ন্ত্রণে আর্গানিক কৃষির প্রচলন ঘটাতে হবে। তাই পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতি ও আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।



পানির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে নির্ণয়ে কথা বলা হয়েছে। যার ফলে অভিজাত এলাকায় গরীব মানুষের তুলনায় বেশি দামে পানি কিনতে হবে। পানির দাম নির্ধারণের দায়িত্ব এলাকার পানি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে ধার্য করার কথা বলা হয়েছে। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানী বিভিন্ন অযুহাতে পানির দাম বাড়াবে।


এছাড়া খসড়া আইনে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য শুল্ক ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে। যা পানির দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। পানি খাত ব্যবস্থাপনার প্রকল্পে বেসরকারিকরনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমরা আশা করব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকার বিবেচনা করবে পানি খাত যেন বানিজ্যিকীকরন না করা হয়।

পানি বাণিজ্যিকীকরণের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা:

সর্ব প্রথম ইংল্যান্ডে স্বল্প মূল্যে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পানি হস্তান্তর করা হয়। মুহুতেই পানির দাম ২৫০ ভাগ বেড়ে যায় এবং শুরু হয় দুর্নীতি। ইংল্যান্ডে পানি ব্যাক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের ফলে সেখানে জনগন অসন্তোষ প্রকাশ করে, ফলোশ্রুতিতে নির্যাতন হয় এবং পরে জনগন তা পরিশোধে বাধ্য হয়। তা প্রতিরোধ আন্দোলন চলতে থাকলেও একে একে ইজিপ্ট, ইন্দোনেশিয়া আর্জেন্টিনায় একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু যখন পানির ব্যাক্তি মালিকানাধীন প্রক্রিয়া বলিভিয়ার কচাবাম্বায় শুরু হয় তখন এমন কিছু হয় যা কখনও সংশ্লিষ্টরা আশা করেনি। পিপাসার্থ গরিব জনগন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরিশেষে এ দেশের জনগন রক্ত বন্যায় পানির অর্থ পরিশোধে বাধ্য হয়। বিক্ষোভকারীদের উপর আর্মিদের বুলেট আর টিয়ার গ্যাস-এর আঘাতে ৬ জন মৃত্যুবরন করে, ১৭৫ জন আহত হয় এবং আর্মির টিয়ার গ্যাসে ২টি শিশু অন্ধ হয়ে যায়। কচাবাম্বা শহরে বিক্ষোভকারীরা লন্ডনের International Water Ltd মালিকানাধীন কোম্পানিকৃত পানির দাম ৩৫ভাগ বৃদ্ধি করায় প্রতিবাদ জানিয়ে ছিল। কচাবাম্বায় হত্যাযজ্ঞ চালানো Hugo Banzer (একনায়কতন্ত্রী, পরবর্তীতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) কারফিউ জারি করে এবং তাদের উচ্ছেদ করে। ২০০০ সালের ১২ এপ্রিল মার্শাল আইন জারির পর World bank -এর প্রেসিডেন্ট Wolfensohn সাংবাদিকদের এক বিবৃতিতে বলেন, আমি এখন খুশি যে বলিভিয়ার দাঙ্গা ভেঙ্গে যাচ্ছে বা শেষ হয়ে যাচ্ছে।


আমাদের দেশে প্রায় ৬০ ভাগ লোক দরিদ্র। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যে সকল দেশে পানি বেসরকারিকরণ করা হয়েছে সে সমস্ত দেশে একটা বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে তাদের নূন্যতম ব্যবহার যোগ্য বা সুপেয় পানি ক্রয় করতে হয়। যদি আমাদের দেশে পানি বেসরকারিকরণ করা হয় তাহলে দেশের দরিদ্র মানুষের উপর এই দায় পড়বে। দেশের সম্পদের মালিক রাষ্ট্র তথা জনগন। এর থেকে সুবিধা দেশের সকল জনগণ ভোগ করে। অথচ সম্পদ বেসরকারিকরণের ফলে এর থেকে সুবিধা হয় শুধুমাত্র কোম্পানীর। যেকোন কোম্পানী পরিচালনা করা হয় মুনাফার কথা চিন্তা করে। এক্ষেত্রে সাধারন জনগনের সুবিধা কিংবা পরিবেশ ও প্রতিবেশের কথা চিন্তা করা হয় না। পানি সম্পদ রক্ষায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পানি নীতি ও আইনে পানি সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সুরক্ষা করার মাধ্যমেই সম্ভব আসন্ন সংকট মোকাবেলা।

পানি খাতে ব্যবস্থাপনা নাকি পানি বানিজ্যিকীকরন, রাজনৈতিক ডট কম থেকে
www.alap.rajnoitik.com