এখনো
বুড়িগঙ্গার সব রূপ হারিয়ে যায়নি।
গত
২৯ সেপ্টেম্বর ছিল নদী দিবস। এই দিনে নদীকে নিয়ে ভালবাসা অথবা নদীকে ভালবাসে
দুনিয়াব্যাপী কোটি মানুষ নদীর পক্ষে লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় মনে প্রাণে। নদীর
প্রতি ভালবাসার এই দিবসে কয়েকজন নদী প্রেমিকের সাথে গিয়েছিলাম বুড়িগঙ্গা নদীর তীর
ঘেষা রাজধানীর একমাত্র জেলে পল্লীতে।
বুড়িগঙ্গায়
অক্সিজেনের মাত্রা কত? বিষাক্ত গ্যাস কোনটা কত আছে? কোথায় কি দূষণ হচ্ছে? নদী নিয়ে
দূর্ণীতি হাজারো সংবাদ পড়ি এই নদীটাকে নিয়ে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার আরো অনেক রূপ আছে।
কাশফুল, বক, মাছরাঙ্গা, পাল তোলা নৌকা, জেলে,মাঝি, নদীকে ঘিরে কতসব উৎসব যে এখনো
টিকে আছে তা অজানাই রয়ে গেল। আজ জানাব
নদীর অন্যরূপ। অন্য একদল মানুষের কথা যারা এখনো এই নদী নিভর। তাদের জীবন জীবিকা এই
নদীকে ঘিরে। প্রতিনিয়ত সংগ্রামের পাশাপাশি তারা স্বপ্ন দেখে আবারও এই নদীটায় বর্ষায়
রুই,কাতল, বোয়াল, পুঁটি ধরা পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে। শীতকালে বাড়া/ঝাপ (গাছের ডাল-পালা
দিয়ে নদীতে মাছ ধরার ফাঁদ ) থেকে আবারও শিং,মাগুর,কৈ, বাইম ধরা পরবে। এখনো বর্ষায়
এই নদী যাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস। বুড়িগঙ্গার জলেই যাদের ঘরের অধিকাংশ
কাজ চলে। সেই মানুষদের গল্প দেখতে আর শুনতে বুড়িগঙ্গা রিভার কিপার শরীফ জামিল ভাই
আজ নদী দিবসে আয়োজন করে জেলেদের সাথে আড্ডা। বুড়িগঙ্গার পাড়ে জেলেদের জেলে পেশায়
টিকে থাকার গল্প শুনে আপনিও অবাক হবেন। এত দূষিত নদীতে কি মাছ থাকে? এই শহরে এখনো
কি করে শত বছরের জেলে পাড়ার লোকগুলো তাদের পেশায় টিকে আছে?
গ্রামের
তরুণরা তাদের প্রবীণদের কাছ থেকে এই নদীর অনেক গল্প শুনেছে। কে কত বড় মাছ ধরেছে এই
নদী থেকে। জেলে পাড়ার মানিক রাজবংশী গর্বের সাথে বলেন এক যুগ আগেও মাছে ভরে যেত
নৌকা। তিনি জানালেন বছর কয়েক আগেও এই পল্লীতে অসংখ্য জেলে-জাল-নৌকা ছিল। মানুষগুলোর মাছ ধরা-কেনা-বেচাই ছিল প্রধান
পেশা। বেপারীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে যেত। ফরিদপুর, পাবনা থেকে লোক আসত এই পল্লীতে রোজ
কামলা খাটতে। গেল বছর শেষবারের মত এসেছিল লোক। এই বছর আসে নদীতে মাছ নেই। তাছাড়া
সারা রাত খেটে পাওয়া যায় জন প্রতি পঞ্চাশ থেকে দুইশ টাকা।
এখন ডিপজল, সোয়ারি ঘাট, কারওয়ান বাজার, নিউ
মার্কেট থেকে পাইকারী বাজার থেকে মাছ কিনে রায়ের বাজারে বিক্রি করে। অনেকে
ভিটে-বাড়ী বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেছে। যারা গেছে তাদের তালিকায় নিজের পরিবারের
লোকও আছে। কিন্তু আমি যেতে পারিনি।
বাপ-দাদা
চৌদ্দ পুরুষের ভিটা।
শুধু
যে ভিটার টানে থাকি তা নয়।
নদীর
প্রতি একটা টান পরে গেছে
কয়েকবার
যেতেও চেয়েছি। মন সায় দেয় না। শান্তি পাই না।
কেন জানি মনে হয়। নদীতে আবারও মাছ পরবে। আমি নৌকা,জাল সব বিক্রি করে দিয়েছি
বেপারিরে দেনা শোধ দিতে। তবে মাছ পড়লেই আবার জাল নিব। মাছ কিনে বিক্রি করে সুখ
নাই। মাছ ধরে বিক্রি করাতে আলাদা আনন্দ আছে।
সন্ধ্যায়
নদীতে দেখা হল সুবল রাজবংশীর সাথে। সে এখনো প্রতিরাতে মাছ ধরতে যায় নদীতে। তার মত
আরো সাতটি নৌকা টিকে আছে এই জেলে পাড়ায়। সন্ধ্যার পর তারা আটজনের দল যায় নদীতে।
সারা রাত মাছ ধরে সকালে বেপারীরা মাছ বিক্রি করে রায়ের বাজারের। মাছের পরিমাণ এখন
খুবই কম তবুও বাপ দাদা পেশাটা আকড়ে ধরে আছে।
কাল
সারা বিকেল জেলেদের সাথে আড্ডার পাশাপাশি উপভোগ করলাম বুড়িগঙ্গার অন্য রূপ। বর্ষায়
কিন্তু জেলে পাড়াটা পুরো ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
নদীর তীর ঘেষে কাশ ফুল। সারি সারি মাছ ধরার নৌকা, তীরে ছাড়ানো মাছ ধরার
জাল, সচ্ছ পানি কি নেই এই নদীতে? এই সবই এখনো অল্প পরিসরে হলেও দেখা যাবে
বুড়িগঙ্গার তীরের জেলে পাড়াতে। শুধু পাওয়া যাবে না বর্ষার এই সচ্ছ জলে মাছ। কিন্তু
মাছ ধরাই যাদের চৌদ্দপুরুষের পেশা,নেশা। তাদের জন্য নদীর অথ অনেক বিস্তৃণ। নদী
তাদের কাছে সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, জীবন-জীবিকা, উৎসব আরো কত কি । তাই তো সুবলের
কন্ঠে যতই কাল হোক নদীর জল এই নদীকে ঘৃণা করি কি করে। এখনো তো তার কৃপায় বেচে আছি।
সন্ধ্যার
পর পর আমরা চলে আসছি মেঠো পথ ধরে, উদ্দ্যেশ বসিলার প্রধান সড়ক থেকে গাড়িতে উঠব।
জেলে পাড়ার নারী-পুরুষ, বাচ্চারা গাড়ি পযর্ন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। গাড়িতে উঠার আগ
মূহুর্তে এক বয়স্ক লোক শরীফ ভাইয়ের হাত চেপে ধরল। বাপ নদীটারে আগের মত করে দাও।
মরার আগে আমি নদীটারে আগের মত দেখতে চাই। নদীর জন্য মানুষটা কাঁদছে। এই জেলের
চোখের জল শুধু কি নদীর জন্য। নাকি নদী কেন্দ্রিক তার ভালবাসা, যে ভালবাসার জন্য
সবাই চলে যাওয়ার পরও বৃদ্ধ ভিটে বাড়ি বিক্রি করে যায়নি।
বুড়িগঙ্গাকে
ঘিরে জেলে পল্লীর এই জেলে পরিবারগুলো সুখ-দুঃখের কথা কখনো কোন নীতি নিধারনীর সভা
সমাবেশে আলোচনা হবে না। কিন্তু আমরা যারা নদী নিয়ে কথা বলি, পরিকল্পনা করি, নদীকে
ভালবাসি তাদের কাছে অনুরোধ একবার এই বর্ষায় সময় করে ঘুরে আসুন বছিলার জেলে পল্লী
থেকে। নদী ঘিরে চলা এই মানুষগুলোর কাছে থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভালবাসতে পারবেন
নদীকে, লড়তে পারবেন নদীর জন্য আরো শক্ত করে।
সৈয়দ
সাইফুল আলম
পরিবেশকর্মী
shovan1209@yahoo.com