Monday 19 April 2010

বিড়ি কারখানায় কাজ করার কারণে শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে।

বৃহত্তর রংপুর ও কুষ্টিয়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর বিড়ি তৈরীর কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের পাশাপাশি প্রচুর শিশুও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে। এসব শিশুরা সাধারণত নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্যহীন পরিবারের সন্তান। ঝুঁকিপূর্ণ বিড়ি শিল্পে কাজ করার কারণে মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি ভবিষ্যতে সু নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে।

যে বয়সে ছেলেরা সকালে ¯কুলে যায়, বিকেলে পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলতে যায়, সে বয়সেই সকালের পড়া আর স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে কোমলমতি এই শিশুদেরকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই নেমে পড়তে হয় উপার্জনের কাজে। ফজরের আজান দিলেই তারা বিড়ি কারখানায় কাজ করতে আসে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। আর্থ সামাজিক অবস্থা খারাপ এবং বিকল্প কাজের সুযোগ না থাকায় শ্রমিকদের বাধ্য হয়ে কারখানায় কাজ করতে হচ্ছে। দারিদ্রতার কারণেই শিশুরা এধরনের ঝুঁকিপূর্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

বিড়ি কারখানায় শিশুরা সধারণত কয়েক ধরনের কাজ করছে:
১) তামাক গুড়া করে বিড়ি তৈরীর উপযোগী করা
২) কাগজের রোল তৈরী করা
৩) কাগজের রোলে তামাক ঢুকিয়ে বিড়ি তৈরী করা
৪) বিড়ি প্যকেজিং ইত্যাদি

আন্তর্জাতিক লেবার অফিস, ঢাকা এর ২০০৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় রংপুরের বিড়ি কারখানাগুলোয় ১৭,৩৪৪ জন শিশু শ্রমিক যার ৯,২১৩ জন ছেলে শিমু ও ৮,১৩১ জন মেয়ে শিশু, টাঙ্গাইলের কারখানাগুলোয় ১,৫৭৭ জন শিশু শ্রমিক যার ৬৪৭ জন জেলে শিশু ও ৯৩০ জন মেয়ে শিশু এবং কুষ্টিয়ার কারখানাগুলোয় ২,২৯৬ জন শিশু শ্রমিক কাজ করছে যার ১,৭০১ জন ছেলে শিশু ও ৫৯৫ জন মেয়ে শিশু।

গবেষণার এই তিনটি অঞ্চলের বাইরেও অনেক শিশু বিড়ি কারখানায় কাজ করছে। উপরিউক্ত গবেষণাতেই দেখাযায় গড়ে প্রতিটি পরিবারে রংপুর এলাকায় ২.০৯ জন, টাঙ্গাইল এলাকায় ১.৪৪ জন ও কুষ্টিয়া এলাকায় ১.২০ জন শিশু বিড়ি কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত।

১৯৬৫ সালের কারখানা আইনের ৮৭ ধারা অনুসারে কোন কারখানায় যদি এমন ধরণের কাজ হয় যার ফলে এতে নিযুক্ত যে কোন ব্যক্তির দৈহিক আঘাত প্রাপ্ত, বিষক্রিয়া বা দৈহিক আঘাতপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে ঐ কাজকে বিপদ জনক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। বিড়ি কারখানায় কাজের ফলে এতে যুক্ত ব্যক্তিদের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে যা তার শরীরে স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সুতরাং অবশ্যই এটি একটি বিপদ জনক কাজ। এই আইনের ৮৭(গ) ধারায় বিপদ জনক কাজে নারী কিশোর ও শিশুদের নিয়োগ স¤পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া শিশু শ্রমিক নিয়োগ আইন ১৯৩৮, শিশুশ্রম বন্ধ আইন ১৯৩৩, শিশু আইন ১৯৭৪ ইত্যাদি আইনেও শিশু শ্রমের ব্যপারে বিভিন্ন বিধি নিষেধ এবয়
নিষেধ অমান্যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

বিড়ি কারখানা শিশু শ্রমিকেরা মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গড়ে উঠা এ কারখানায় শিশু শ্রমিকদের ঝুকিঁর মধ্যে কাজ করতে হয়। বিড়ি তৈরীর সময় তাদের নাকমুখ দিয়ে তামাকের গুড়া প্রবেশ করছে অহরহ। এছাড়া কাজের প্রতিটি মুহুর্ত তারা কাটাচ্ছে তামাকের উৎকট গন্ধের মধ্যে এভাবে তারা মারাত্বক রোগ ক্যান্সারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্যান্সারের পাশাপাশি তারা শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, যক্ষা, চোখের বিভিন্ন রোগসহ নানাধরনের জটিল অসুখে ভুগছে। কারখানা গুলোতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থাও নেই। শ্রমিকদের ফ্রি ধূমপানের ব্যবস্থা থাকায় অনেকেই এ সুযোগ গ্রহণ করছে। এ সুযোগে বিড়ি তৈরীর সাথে জড়িত সকল শিশু অল্প বয়সেই ধূমপায়ী হয়ে পড়ছে। এ কারণে ভবিষ্যতে এ সব শ্রমিকদের বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হবার ঝুকিঁ অনেক গুন বেড়ে যাচ্ছে।


আমাদের দেশে শিশুর সংগা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ অনুসারে ১৮ বছরে নীচে সকলকে শিশু বলা হলেও আমাদের দেশে বিভিন্ন আইনে শিশুর সংগায় বিভিন্ন বয়সসীমার কথা বলা হয়েছে। কারখানা আইনের ৬৬ ধারা অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সী কোন শিশুকে কোন ভাবেই কারখানায় নিযুক্ত করা যাবে না। ১৪ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুকে শর্ত পুরণ সাপেক্ষে কারখানায় নিযুক্ত করা যাবে। তবে এসব শিশুকে দৈনিক ৫ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। এবং তাদের কাঝের এই ৫ ঘন্টা সকাল ৭টা থেকে সন্ধথ্যা ৭টার মধ্যে হতে হবে। তাছাড়া তার এই কর্ম ঘন্টার মধ্যে তার বিনোদন ও বিশ্যামের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বিড়ি কারখানায় শিশু শ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি টানা কাজ করছে। এবং সর্ব নিম্ন ৫ বছরের শিশুথেকে সব বয়সী শিশুরা এই কাজে যুক্ত।

একহাজার বিড়ি বাধলে একজন শিশু মজুরী পায় ৯ থেকে ১১ টাকা (স্থান ভেদে ভিন্নতা আছে)। একজন শিশু সারাদিন কাজ করে ৩০ থেকে ৫০ টাকা আয় করতে পারে।

বিড়ি কারখানায় কাজ করার কারণে শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে। লেখাপড়া শিখে একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন কুঁড়িতেই নষ্ট হচ্ছে। ফলে তারা একটি দারিদ্রের দুষ্টু চক্রে বাধা পড়ে যাচ্ছে। বাপ-দারা যে দরিদ্র জীবন যাপন করেছে তা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় তার থাকছে না। এছাড়া তামাকের মত ক্ষতিকর দ্রব্যের সংস্পর্শে জীবসের একটা এল্লথযোগ্য অংশ কাটানোর কারণে এবং তামাকের ডাস্ট প্রতিনিয়ত শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ফলে অল্প বয়সেই এরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্ম ক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে তার দারিদ্রতা স্থায়ী রূপ লাভ করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও তা মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বিড়ি কারখানার পাশাপাশি বাংলাদেশের তামাক চাষেও প্রচুর শিশু শ্রকি কাজ করছে যার ফলেও নষ্ট হচ্ছে তার ভবিষ্যত এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরী হওয়ার ঝুঁকি থাকছে তার।

আন্তর্জাতিক শিশু সনদ অনুসারে শিশুর স্বুস্থভাবে বেড় ওঠা ও তার মৌলিক চাহিদা পুরণের নিশচয়তা থাকতে হবে। এবং তা পুরণ করবে রাষ্ট্র। তাছাড়া আমাদের পবিত্র সংবিধানেও শিশুদের স্বুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়েওঠার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও তার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের করণীয় বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

No comments:

Post a Comment